ভিএআরের আদ্যন্ত

021515KK_Dhaka360_18-06-08-30

বিশ্বকাপ দেখতে সবার আগে জানতে হবে যা

বিশ্বকাপ দেখতে বসলেন। প্রিয় দল গোল করল। উল্লাস শুরু করবেন! একটু থামতে হবে। কারণ ভিএআর। ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি নামের নতুন এই প্রযুক্তি যোগ হচ্ছে এবারের টুর্নামেন্টে, যার মাধ্যমে পুনর্বিবেচনা হবে মাঠের রেফারির সিদ্ধান্তের। কিভাবে কাজ করবে সেটি, না জানলে উপভোগই করতে পারবেন না বিশ্বকাপ। সেই সমস্যা দূর করতেই আমাদের এই আয়োজন

 

’৬৬ বিশ্বকাপে জিওফ হার্স্টের সেই গোল, ’৮৬ বিশ্বকাপের ‘হ্যান্ড অব গড’ অথবা জার্মানির বিপক্ষে ফ্রাংক ল্যাম্পার্ডের রেফারির চোখ এড়িয়ে যাওয়া গোল—উদাহরণ কম নয়। এমন ঘটনা যেন ভবিষ্যতে আর না ঘটে, রেফারি যেন খেলার পরিস্থিতি বদলে যাবে এমন কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে সর্বোচ্চ তথ্য-উপাত্ত ব্যবহারের সুযোগ পান, সে জন্যই ফিফা রাশিয়া বিশ্বকাপ থেকে চালু করছে ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি প্রযুক্তি (ভিএআর)।

 

১৯৬৬ বিশ্বকাপ ফাইনাল। ওয়েম্বলি। মুখোমুখি ইংল্যান্ড-পশ্চিম জার্মানি। ৯০ মিনিটে ২-২ গোলে ড্র থাকায় ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেখানে অ্যালান বলের কাছ থেকে পাস পাওয়ার পর জিওফ হার্স্টের ডান পায়ের জোরালো শট রুখতে পারেনি জার্মান গোলরক্ষক। বল গিয়ে আঘাত করে ক্রসবারে; মাটিতে ড্রপ করার পর তা ক্লিয়ার করেন জার্মান ডিফেন্ডার। কিন্তু ইংল্যান্ডের দাবি বার থেকে নিচে নামা বল মাটিতে পড়ার সময় গোললাইন পেরিয়ে গেছে। পশ্চিম জার্মানির দাবি ভিন্ন। শেষে লাইন্সম্যানের সঙ্গে কথা বলে সেটিকে গোল ঘোষণা করেন রেফারি। কিন্তু বলটি কি সত্যি গোললাইন পেরিয়েছিল, নাকি পেরোয়নি?

১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল। মুখোমুখি আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ড। এবার ডিয়েগো ম্যারাডোনার সেই ঈশ্বরের হাতের গোল। ইংল্যান্ডের গোলরক্ষক পিটার শিলটনসহ অন্যরা প্রতিবাদ করেছিলেন। রেফারি তাতে কান দেননি। রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে শিলটন তো এখনো ক্ষমা করেননি ম্যারাডোনাকে। তাঁর সঙ্গে কখনো হাত মেলাবেন না বলেও জানিয়েছেন।

এবার ২০১০ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ড। জার্মানি-ইংল্যান্ডের লড়াই। ১-২ গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় ফ্রাংক ল্যাম্পার্ডের শট রুখতে পারেননি মানুয়েল নয়ার। কিন্তু ওই যে বাধা সেই ক্রসবার। নিচের দিকে লেগে বল ড্রপ খাবার পর আয়ত্তে নেন জার্মান গোলরক্ষক। ইংল্যান্ডের দাবি, বল গোললাইন পেরিয়ে গিয়েছিল; রেফারি তাতে সায় দেননি। ম্যাচটিও পরে ১-৪ গোলে হেরে যায় ইংল্যান্ড।

এ তো কয়েকটি মাত্র উদাহরণ। বিশ্বকাপের মঞ্চে এমন বিতর্কিত ঘটনা রয়েছে অনেক। রেফারি, লাইন্সম্যানের মানবীয় ভুলের কারণে অনেক দল মেতেছে অপ্রত্যাশিত আনন্দে; অনেকে আবার প্রাপ্যটুকুও পায়নি। ডুবে যেতে হয়েছে হতাশায়।

তবে সে দিন ফুরোল বলে। এবারের বিশ্বকাপে যে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হবে ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি প্রযুক্তি; সংক্ষেপে যা ভিএআর। গেল মার্চে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর কণ্ঠে ছিল উচ্ছ্বাস, ‘এটি একটি প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত; খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক। ২০১৮ সালে এসে এটি তো সম্ভব না যে, স্টেডিয়াম ও টিভির সামনে বসে থাকা সবাই জানল রেফারি বড়সড় ভুল করেছেন কি না। অথচ শুধু ওই রেফারিই তা জানলেন না। এখন এই প্রযুক্তির কারণে ফুটবলে ভুল কমে অনেক বেশি স্বচ্ছতা আসবে।’

ভিএআর প্রযুক্তি অনেকটা ক্রিকেটের থার্ড আম্পায়ারের মতো। যেখানে টেলিভিশন রিপ্লে দেখে রেফারি তাঁর সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করতে পারবেন। ‘স্পষ্ট ও নিশ্চিত ভুল’ এবং ‘চোখ এড়িয়ে যাওয়া গুরুতর ঘটনা’ পুনরায় পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত বদলের ক্ষমতা থাকবে রেফারির কাছে। শুধু চার ঘটনায় প্রযুক্ত হবে ভিএআর প্রযুক্তির ব্যবহার—১. গোল ২. পেনাল্টি ৩. সরাসরি লাল কার্ড এবং ৪. খেলোয়াড়দের ভুলভাবে চিহ্নিত করা। এ ঘটনাগুলো ম্যাচের গতিপথ বদলে দিতে পারে বলে সেখানে ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির সাহায্য নিতে পারবেন রেফারিরা।

বিশ্বকাপে ব্যবহারের আগে প্রায় দেড় বছর পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে ভিএআর প্রযুক্তি। ২০১৭ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত কনফেডারেশনস কাপে তা ছিল। গেলবারের বিশ্ব ক্লাব কাপেও। গত মৌসুমের জার্মান বুন্দেসলিগা ও ইতালিয়ান সিরি ‘এ’তেও ব্যবহার করা হয় তা। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে না থাকলেও এফএ কাপ, লিগ কাপের অনেক ম্যাচের গতিপথ পাল্টে গেছে ভিএআর প্রযুক্তির মাধ্যমে। এবার বিশ্বকাপের ৩৬ জন রেফারি এবং তাঁদের সহকারীরা নিতে পারবেন এ সুবিধা।

২০১৪ বিশ্বকাপে গোললাইন প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করে ফিফা। এবার ভিএআর। মাত্র চারটি ক্ষেত্রে এটি সীমিত রাখা হয়েছে, যাতে খেলার প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ‘স্পষ্ট ও নিশ্চিত’ ভুলের সংজ্ঞায় সংশয়ের অবকাশ থাকতে পারে, বিশেষত গোল পর্যালোচনার সময় অফসাইডের সিদ্ধান্তের কারণে। ওই গোলের সময় একজন ফুটবলার যদি সামান্যতম ব্যবধানেও প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের চেয়ে এগিয়ে থাকেন, ভিএআর সেটিকে ‘স্পষ্ট ও নিশ্চিত ভুল’ হিসেবেই দেখবে। কারণ অফসাইডের ব্যাপারটিই এমন—হয় অফসাইড, নয় অফসাইড নয়। এর মাঝামাঝি কিছু নেই।

ভিডিও রেফারিরা মাঠে থাকবেন না। মস্কোতে কেন্দ্রীয় ভিডিও অপারেশন রুমে থেকে কাজ করবে ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির দল। রাশিয়া বিশ্বকাপে সে দলের সদস্যসংখ্যা ১৩। সব ব্রডকাস্ট ক্যামেরায় প্রবেশাধিকার তো থাকবেই তাঁদের; পাশাপাশি দুটি ক্যামেরা নিয়োজিত থাকবে শুধু অফসাইড ধরার জন্য। রেফারির সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে তাঁদের। সেভাবেই জানাবেন যে, রেফারিদের কোনো ভুল হলো কি না।

ক্রিকেটে যেমন ক্রিকেটারদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রিভিউ করা হয়, ফুটবলে তা নয়। ভিএআর ব্যবহারের সিদ্ধান্ত ফুটবলারদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হবে না। সিদ্ধান্ত নেবেন রেফারি। আর ভিএআরের আওতাধীন থাকবে ওই নির্দিষ্ট ঘটনা যে আক্রমণাত্মক পর্যায় থেকে শুরু হয়েছে, সেখান থেকে।

ভিএআরের বেশ কিছু সমালোচনাও রয়েছে। ম্যাচের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে দাবি অনেকের। এ প্রযুক্তির কারণে প্রথমার্ধেই পাঁচ-ছয় মিনিট করে বাড়তি সময় খেলানোর ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ফুটবলীয় আইনের সাবজেক্টিভ ধরন বা মতভেদও একটি ব্যাপার। রিপ্লের সুবিধা নেওয়ার সুযোগ হয়তো থাকছে কিন্তু কিছু সিদ্ধান্ত তো হয় একেবারে ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে। যেমন পেনাল্টি কিংবা লাল কার্ডের ঘটনা। একই ঘটনায় একজন রেফারি হয়তো পেনাল্টি-লাল কার্ড দেবেন, আরেকজন হয়তো দেবেন না। তা ভিএআর প্রযুক্তি ব্যবহার করেও। গোল করার পর যে উল্লাস, সেই স্বতঃস্ফূর্ততা থাকবে না, কেননা সে গোল তো বাতিলও হয়ে যেতে পারে! আর সর্বোপরি বিশ্বের বড় বড় সব লিগে এ প্রযুক্তি কয়েক মৌসুম ব্যবহার না করে সরাসরি বিশ্বকাপে ব্যবহার করায় এ নিয়ে নানা ধোঁয়াশা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়।

তবে ফিফা প্রেসিডেন্ট ইনফান্তিনো তা আমলে আনছেন না। ভিএআর প্রযুক্তি ফুটবলকে প্রায় নিখুঁত করে তুলবে বলে দাবি তাঁর। ‘সমর্থক, কোচ ও ফুটবলারদের আমি আশ্বস্ত করতে চাই যে, ভিএআর প্রযুক্তির ইতিবাচক প্রভাব পড়বে ফুটবলে। আমাদের গবেষণার ফল তা-ই বলছে। প্রায় এক হাজার ম্যাচের ওপর আমরা গবেষণা করেছি। তাতে নির্ভুলতার মাত্রা ৯৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৯ শতাংশ। এটি প্রায় নিখুঁত।’

নিখুঁত হয়তো হবে। হয়তো রেফারির ভুল কমে আসবে। ’৬৬-র হার্স্টের গোলের মতো গোল হবে না। আবার একই সঙ্গে চিন্তা করুন, বিশ্বকাপ ফাইনালে লিওনেল মেসি কিংবা ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো বা নেইমার পাঁচ-ছয়জনকে কাটিয়ে অবিস্মরণীয় এক গোল করলেন। এরপর পাঁচ মিনিট পর ভিএআর জানাল, সেটি কোনো এক কারণে গোল নয়। তাহলে?

রাশিয়া বিশ্বকাপে তাই ভিএআরকে বড় অগ্নিপরীক্ষার সামনেই পড়তে হবে।

 

 

তিনভাবে কাজ করবে

১.

গোল, পেনাল্টি, সরাসরি লাল কার্ড এবং খেলোয়াড়দের ভুলভাবে চিহ্নিত করা—এই চার ঘটনার মধ্যে কোনোটি হলে ভিডিও রেফারি ইয়ারপিসের মাধ্যমে মাঠের রেফারির সঙ্গে কথা বলবেন। মাঠের রেফারি তখন হাত ওপরে তুলে খেলোয়াড়দের জানাবেন যে সিদ্ধান্তটি রিভিউ করা হচ্ছে। যদি দেখা যায়, তাঁর সিদ্ধান্তে কোনো ভুল হয়নি, তখন আবার খেলা শুরুর সিগন্যাল দেবেন তিনি।

 

২.

এবার ভিএআরের সিদ্ধান্ত। এ ক্ষেত্রে রেফারি হাত দিয়ে টিভি স্ক্রিনের আয়তক্ষেত্রের সিগন্যাল দেবেন। এবার ভিডিও রেফারি ঘটনাটি রিভিউ করবেন। যদি এরপর মাঠের রেফারি তাঁর সিদ্ধান্ত বদলাতে চান, তাহলে ওই হাত দিয়ে ওই আয়তক্ষেত্রের সিগন্যাল দেবেন আবার।

 

৩.

এটি ‘অন ফিল্ড রিভিউ’। মতামতনির্ভর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ভিডিও রেফারি নির্দেশনা দেবেন মাঠের রেফারিকে, যেন তিনি মাঠের পাশে থাকা স্ক্রিনে ঘটনার রিপ্লে দেখেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানোর আগে তিনি ওই টিভির সিগন্যাল দেবেন।