‘বন্দুকযুদ্ধে’ পৌর কাউন্সিলরসহ নিহত আরো ১০

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে শনিবার দিবাগত রাত থেকে পরদিন গতকাল রবিবার ভোর পর্যন্ত ১০ জেলায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে ১০ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে কক্সবাজারে র্যাবের অভিযানে একজন পৌর কাউন্সিলর নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া বাগেরহাট, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, ময়মনসিংহ, ঠাকুরগাঁও, খুলনা ও কুষ্টিয়ায় পুলিশের অভিযানে একজন করে নিহত হয়েছে। পুলিশের দাবি মতে, মেহেরপুর ও ঝিনাইদহে মাদক কারবারিদের অন্তঃকোন্দলে গুলিতে নিহত হয়েছে দুজন।
অভিযান পরিচালনাকারী র্যাব-পুলিশের পক্ষ থেকে এসব ঘটনার যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা মোটামুটি একই ধরনের। বলা হয়েছে, নিহত প্রত্যেকে চিহ্নিত মাদক কারবারি। তাদের বিরুদ্ধে মাদক ও অন্যান্য অভিযোগে থানায় বেশ কিছু মামলা রয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে গত ৪ মে সারা দেশে শুরু হওয়া র্যাব-পুলিশের এই বিশেষ অভিযানে গতকাল রবিবার পর্যন্ত ২৪ দিনে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৭। আমাদের স্থানীয় অফিস, নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন বিস্তারিত।
কক্সবাজার : টেকনাফ সীমান্তে শনিবার দিবাগত রাতে র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে একজন নিহত হয়েছেন। তিনি হলেন টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর একরামুল হক (৪৬)।
র্যাব-৭, চট্টগ্রাম গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শনিবার রাত ১টা ৫ মিনিটে র্যাব-৭-এর একটি দল টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ এলাকায় অভিযান চালায়। মাদক কারবারিরা টের পেয়ে র্যাবকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়লে র্যাব পাল্টা গুলি চালায়। গোলাগুলির একপর্যায়ে মাদক কারবারিরা পালিয়ে যায়। এ সময় ঘটনাস্থলে একজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। তাত্ক্ষণিকভাবে আহত ব্যক্তিকে টেকনাফ সদর হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় দুই র্যাব সদস্যও আহত হন।
র্যাবের পক্ষ থেকে গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, কাউন্সিলর একরামুল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারি ও ইয়াবার শীর্ষ গডফাদার ছিলেন।
র্যাব-কক্সবাজারের কম্পানি কমান্ডার মেজর মো. রুহুল আমিন বলেন, শনিবার দিবাগত রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মিঠাপানির ছড়া এলাকায় র্যাবের সঙ্গে এক বন্দুকযুদ্ধে একরামুল নিহত হন। পরে সেখান থেকে একটি বিদেশি রিভলবার, পাঁচ রাউন্ড গুলি ও ১০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
এসব বিষয়ে টেকনাফ থানার ওসি রণজিত কুমার বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, নিহত পৌর কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ইয়াবাসংক্রান্ত কোনো মামলা নেই। এ মর্মে পুলিশের কাছে কোনো রেকর্ডও নেই।
বাগেরহাট : চিতলমারীতে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এক ব্যক্তি নিহত হয়েছে। গতকাল ভোরে উপজেলার চিংগুড়ি গ্রামে এ ঘটনায় পাঁচ পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে ১০০ পিস ইয়াবা, দুই কেজি গাঁজা, একটি শাটারগান, দুই রাউন্ড গুলি ও একটি ছোরা উদ্ধার হয়েছে।
চিতলমারী থানার ওসি অনুকূল চন্দ্র সরকার জানান, নিহত মিটুল বিশ্বাসের (৪৫) বাড়ি চিংগুড়ি গ্রামে। সে এলাকায় মাদক সম্রাট হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৫টি মামলা রয়েছে।
বাগেরহাটের পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায় বলেন, গোয়েন্দা (ডিবি) ও থানা পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে শনিবার রাতে উপজেলার কুনিয়া এলাকা থেকে মিটুলকে আটক করে। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গতকাল ভোর সোয়া ৩টার দিকে মিটুলকে নিয়ে মাদক উদ্ধারে বের হয় পুলিশ। মিটুলের বাড়িতে পৌঁছানোর আধাকিলোমিটার আগে একটি বাগানে ওত পেতে থাকা মিটুলের সহযোগীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে পুলিশ পাল্টা গুলি চালায়। এ সময় মিটুল গুলিবিদ্ধ হয়। গুরুতর অবস্থায় তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম) : উপজেলার বাড়বকুণ্ডে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ রায়হান উদ্দিন রেহান (২৮) একজন নিহত হয়েছে। পুলিশ জানায়, সীতাকুণ্ডের গোলাবাড়িয়া গ্রামের রেহান নড়ালিয়া সাগর উপকূলীয় বেড়িবাঁধ এলাকায় শনিবার গভীর রাতে দলবল নিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে জড়ো হয়েছে মর্মে খবর পেয়ে পুলিশ তাদের ঘিরে ফেললে দুই পক্ষে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় রেহান। এ সময় পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশ তার তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে দুটি এলজি, ১০ রাউন্ড কার্তুজ ও পাঁচ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
সীতাকুণ্ড থানার ওসি ইফতেখার হাসান ও পরিদর্শক (তদন্ত) মোজাম্মেল হক বলেন, ডাকাত ও মাদক কারবারি রেহানের বিরুদ্ধে ডাকাতি, হত্যা, মাদক ও অস্ত্র আইনে কমপক্ষে সাতটি মামলা রয়েছে।
চাঁদপুর : মতলবে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে সেলিম প্রধানিয়া নামের একজন নিহত হয়েছে। গতকাল ভোরে উপজেলার শীলমন্দির বালুর মাঠ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলি ও বোমার আঘাতে চার পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশ দাবি করেছে, সেলিম প্রধানিয়া একজন কুখ্যাত মাদক কারবারি। ঘটনার পর গুলি ও গুলির খোসা, ধারালো অস্ত্র এবং বেশ কিছু ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
মতলব দক্ষিণ থানার ওসি কুতুবউদ্দিন জানান, সাত মামলার আসামি চিহ্নিত মাদক কারবারি সেলিমের গ্রামের বাড়ি হাজীরদোনে। থানা ও ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার ও বেশ কিছু ইয়াবা উদ্ধার করে। পরে থানায় নিয়ে যাওয়ার পথে সেলিমের সহযোগীরা হামলা চালালে সেলিম নিহত হয়।
ময়মনসিংহ : কথিত বন্দুকযুদ্ধে ময়মনসিংহে এক যুবক নিহত হয়েছে। জেলা ডিবির ওসি আশিকুর রহমান জানান, মাদক বিক্রির খবর পেয়ে শনিবার মধ্যরাতে তারা শহরের মরাখলা এলাকায় অভিযান চালালে মাদক কারবারিরা গুলি করে। উভয় পক্ষের গোলাগুলির একপর্যায়ে অন্যরা পালিয়ে গেলেও একজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঘটনাস্থলে পড়ে থাকে। পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ডিবি পুলিশের দাবি, নিহত ব্যক্তি একজন মাদক কারবারি। তবে তাত্ক্ষণিকভাবে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ ঘটনায় ডিবির দুই কনস্টেবলও আহত হন। ঘটনাস্থল থেকে হেরোইন ও ইয়াবা এবং চারটি গুলির খোসা ও ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
মেহেরপুর : গাংনীতে দুই দল মাদক কারবারির ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হাফিজুল ইসলাম হাফি (৪৫) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছে। পুলিশ জানায়, হাফি একজন মাদক কারবারি। তার বিরুদ্ধে মাদকসংক্রান্ত ১৩টি মামলা রয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র ও ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়েছে।
গাংনী থানার ওসি হরেন্দ্রনাথ সরকার জানান, দুই দল মাদক কারবারির বন্দুকযুদ্ধ চলার খবর পেয়ে শনিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে উপজেলার গাড়াবাড়িয়া গ্রামে অভিযান চালানো হয়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মাদক কারবারিরা পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে একজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেল চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরে স্থানীয় লোকজন তার লাশ শনাক্ত করে। নিহত হাফিজুল ইসলাম হাফি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হারেজ উদ্দীনের ছেলে।
ঠাকুরগাঁও : রাণীশংকৈল উপজেলায় গতকাল ভোরে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে রফিকুল ইসলাম লাদেন (৪২) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছে। নিহত লাদেন উপজেলার শিয়ালডাঙ্গী গ্রামের হুমায়ন কবিরের ছেলে।
ঠাকুরগাঁওয়ের পুলিশ সুপার ফারহাত আহমেদ জানান, গোপন সংবাদ পেয়ে রাণীশংকৈল থানার ওসি আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল ধর্মগড় বর্নীয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে মাদক কারবারি লাদেনকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে নিয়ে মাদক উদ্ধারের জন্য কাশিপুর মহারাজাহাট এলাকায় গেলে মাদক কারবারিরা হামলা চালায়। পুলিশ পাল্টা গুলি চালালে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে লাদেন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। এ ঘটনায় দুই পুলিশও আহত হন।
ঝিনাইদহ : শৈলকুপায় দুই দল মাদক কারবারির বন্দুকযুদ্ধে লিটন মোল্লা (৩৫) নামের একজন নিহত হয়েছে। গতকাল ভোরে উপজেলার বড়দাহ গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। পরে ঘটনাস্থল থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও মাদক উদ্ধার করা হয়।
শৈলকুপা থানার ওসি আলমগীর হোসেন জানান, মাদক কারবারিদের বিরোধের জের ধরে এই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। পরে স্থানীয়দের মাধ্যমে পুলিশ জানতে পারে যে নিহত লিটন মোল্লা একজন মাদক কারবারি। তার বিরুদ্ধে মাদকের একাধিক মামলা রয়েছে। সে উপজেলার শেখপাড়া গ্রামের হাকিম মোল্লার ছেলে।
খুলনা : পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ খুলনায় আবুল কালাম মোল্লা (৪০) নামের একজন নিহত হয়েছে। শনিবার রাত পৌনে ৩টার দিকে দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর গ্রামের খেয়াঘাটসংলগ্ন শ্মশান ঘাটে এ ঘটনা ঘটে। নিহত কালামের বাড়ি যশোরে অভয়নগর উপজেলার ইছামতী গ্রামে।
জেলা এসবির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনিচুর রহমান জানান, এসবি ও থানা পুলিশের যৌথ দল শনিবার রাত দেড়টার দিকে শ্মশানঘাটে বিপরীত দিক থেকে দুটি মোটরসাইকেলে আসা অজ্ঞাতপরিচয় চার ব্যক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে। এ সময় তারা ককটেল নিক্ষেপ করলে পুলিশ গুলি চালায়। সন্ত্রাসীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। গোলাগুলি ও বোমার শব্দ শুনে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে তাদের সহায়তায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত একজনকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ১০০ পিস ইয়াবা, চারটি ককটেল ও আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে। আবুল কালামের বিরুদ্ধে মাদকসংক্রান্ত পাঁচটি মামলা রয়েছে।
কুষ্টিয়া : পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ কুষ্টিয়ায় হালিম মণ্ডল (৩৫) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছে। শনিবার রাত দেড়টার দিকে শহরের হাউজিং ডি ব্লক মাঠে এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানায়, নিহত ব্যক্তি তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারি। ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র, গুলি ও মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। নিহত হালিমের বাড়ি সদর উপজেলার বড়িয়া গ্রামে।
সদর মডেল থানার ওসি নাসির উদ্দিন জানান, মাদক বিকিকিনির উদ্দেশ্যে একদল মাদক কারবারি শহরের হাউজিং ডি ব্লক মাঠে অবস্থান করার খবর পেয়ে পুলিশ অভিযানে গেলে টের পেয়ে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। এ সময় একজন গুলিবিদ্ধ হয়। তাকে জেনারেল হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় চার পুলিশ সদস্যও আহত হন।