নির্বাচনের বছরে সরকারি টাকায় উন্নয়ন প্রচার

নির্বাচনের বছরে সরকারি টাকায় জনগণের সামনে ক্ষমতাসীনদের উন্নয়ন তুলে ধরা হবে। গত কয়েক বছরে দেশের উন্নয়নে সরকার কী কী করেছে, কেমন উন্নতি হয়েছে, তা তুলে ধরতে ইতিমধ্যে ৬০ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে গণযোগাযোগ অধিদপ্তর। এতে নির্বাচনের বছরে ক্ষমতাসীন দলই সুবিধা পাবে।

প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি ইউনিয়নে উন্নয়নসংক্রান্ত ভিডিও চিত্র দেখানো হবে। পাশাপাশি সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। হবে নারী সমাবেশও। আবার এসব অনুষ্ঠান যারা দেখতে যাবে, তাদের আপ্যায়নও করা হবে। সব মিলিয়ে সবকিছুই হবে নির্বাচনমুখী।

গত মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেয়েছে ৫৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে প্রচার কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ প্রকল্প। এখনো প্রকল্পটির কাজ পুরোদমে শুরু হয়নি। প্রস্তুতি চলছে বলে গণযোগাযোগ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।

এই প্রকল্পের আওতায় প্রধানমন্ত্রীর ১০টি বিশেষ উদ্যোগ যেমন একটি বাড়ি একটি খামার, আশ্রয়ণ, ডিজিটাল বাংলাদেশ, শিক্ষা সহায়তা কার্যক্রম, সবার জন্য বিদ্যুৎ, কমিউনিটি ক্লিনিক ও শিশু বিকাশ, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের যাবতীয় বিষয় গ্রামীণ জনগণের সামনে তুলে ধরা হবে। এ ছাড়া গত আট বছরে বাংলাদেশ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেসব সাফল্য অর্জন করেছে, তা-ও তুলে ধরা হবে। আর জনগণের সামনে তুলে ধরতে আয়োজন করা হবে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, লোকগীতি অনুষ্ঠান, নারী সমাবেশ, ফেসবুক, ইউটিউব, রেডিও-টিভিতে প্রচার কার্যক্রম।

এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে তথ্য মন্ত্রণালয়ের গণযোগাযোগ অধিদপ্তর। প্রকল্পের মেয়াদ গত নভেম্বর মাস থেকে শুরু হয়ে ২০২০ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত। প্রকল্প নথি অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্প ব্যয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ বা সাড়ে ৫৩ কোটি টাকা খরচ হয়ে যাবে।

এই প্রকল্পটি সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এই ধরনের প্রকল্প নেওয়ার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। এসব প্রকল্পে কোনো উন্নয়ন হয় না। মূলত নির্বাচন সামনে রেখেই এই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। প্রকারান্তরে জনগণের কাছে ভোট চাওয়া হবে।

নির্বাচন সামনে রেখে প্রকল্প নেওয়া নতুন কিছু নয়। চলতি অর্থবছরেই নির্বাচন সামনে রেখে সাংসদদের জন্য নিজের আসনে পছন্দ অনুযায়ী স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দির নির্মাণের জন্য তিনটি প্রকল্প পাস করা হয়েছে। আবার মাদ্রাসা, গণশৌচাগার, হাটবাজার নির্মাণের আরও তিনটি প্রকল্প পাসের অপেক্ষায় আছে। আট বছর ধরে নিজের এলাকার রাস্তাঘাট নির্মাণে বছরে তিন থেকে পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়ে আসছেন তাঁরা। এবার যোগ হলো উন্নয়ন প্রচারের প্রকল্প।

উন্নয়ন প্রচার প্রকল্পের আওতায় প্রধান কর্মসূচি হলো ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’। এতে প্রতিটি ইউনিয়নে সার্বিক উন্নয়নের খতিয়ান তুলে ধরে ভিডিও চিত্র দেখানো হবে। উপস্থিত দর্শকদের আপ্যায়ন করা হবে। আর তাদের মাঝে উন্নয়নের যাবতীয় তথ্য তুলে ধরে এক হাজার লিফলেট বিতরণ করা হবে। ১০ কোটি টাকা খরচ করে ৪৫ লাখ ৫৪ হাজার লিফলেট বানানো হবে।

গণযোগাযোগ অধিদপ্তরের পরিচালক জসীম উদ্দিন প্রথম আলোকে জানান, আগামী জুলাই মাস থেকে এই প্রকল্পের কাজ পুরোদমে শুরু হবে। এর আগে জনবল নিয়োগ, বাড়ি ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করা হবে। প্রদর্শনী, সংগীতানুষ্ঠানে গত কয়েক বছরের উন্নয়নই প্রাধান্য পাবে।

চলচ্চিত্র আর লোকগীতিতে উন্নয়ন

দেশের ৪ হাজার ৫৫৪টি ইউনিয়নের প্রতিটিতেই পিকআপ ট্রাকের ওপর এলইডি স্ক্রিন স্থাপন করে ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা হবে। প্রদর্শনীর জন্য প্রতিটি ইউনিয়নের একটি স্কুলমাঠকে বেছে নেওয়া হবে। আর সারা দেশে ভিডিও চিত্র প্রদর্শনের জন্য ২০টি দল থাকবে। দলগুলো সারা দেশ ঘুরে ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করবে। প্রতিটি দল প্রতিদিন কমপক্ষে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করবে। প্রতিটি জেলায় মাসে কমপক্ষে ২০টি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে। সব মিলিয়ে এমন প্রদর্শনী হবে ২১ হাজার ৩৬০টি। মোট পাঁচটি চলচ্চিত্র বা ভিডিও চিত্র তৈরি করা হবে। প্রতিটিতে খরচ হবে ১ লাখ টাকা। ফেসবুক ও ইউটিউবেও উন্নয়ন কার্যক্রমের এসব ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা হবে। রেডিও-টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন আকারেও উন্নয়ন তুলে ধরা হবে। সব মিলিয়ে এসব কার্যক্রমে ৩৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা প্রকল্প ব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশ।

ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা, জারি-সারির মতো লোকগীতির মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন তুলে ধরা হবে। এতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় লোকগীতিই প্রাধান্য পাবে। প্রতিটি ইউনিয়নে অন্তত দুটি করে লোকগীতির অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে। সব মিলিয়ে সারা দেশে ৯ হাজার ৭৯২টি অনুষ্ঠান হবে। এতে খরচ হবে প্রায় ২ কোটি টাকা। প্রত্যেক লোকগীতিশিল্পীকে প্রতিটি অনুষ্ঠানের জন্য ৭০০ টাকা করে সম্মানী দেওয়া হবে। সম্মানী বাবদ খরচ হবে সাড়ে ৩ কোটি টাকা।

এ ছাড়া প্রতিটি উপজেলায় বছরে একটি করে মহিলা সমাবেশ হবে। ব্যানার, মঞ্চ সাজসজ্জা, অংশগ্রহণকারীদের আপ্যায়ন বাবদ বাজেট ১৫ হাজার টাকা।

আবার উন্নয়ন প্রচারণা দেখতে যারা যাবে, তাদের খালিমুখে বসে থাকতে হবে না। তাদের প্রত্যেককেই নাশতা দেওয়া হবে। আপ্যায়ন বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে সোয়া ২ কোটি টাকা।

এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সবশেষে বলেন, উন্নয়ন হলে জনগণ তো দেখতেই পায়। নতুন করে প্রচার-প্রচারণার দরকার হয় না। এ ছাড়া ক্ষমতাসীনদের উন্নয়ন প্রচারে সরকারি রেডিও-টেলিভিশন তো আছে। এই প্রকল্প থেকে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের লোকজন লাভবান হবেন।